আল্লাহ্ ও রাসুল (সঃ) এর প্রতি ভালো বাসা।
আল্লাহ্ ও রাসুল (সঃ) এর প্রতি ভালো বাসা।
ভালোবাসার পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট
এক.
ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে পাওয়ারফুল একটা টুল। ভালোবাসা পাবার জন্য মানুষ নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারে, অন্যের জীবন কেড়ে নিতে পারে।
একটা দেশ আরেকটা দেশকে আক্রমণ করে, কারণ সে আধিপত্য বিস্তার করতে ভালোবাসে। ক্ষমতায় যাবার জন্য, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না। কারণ সে ক্ষমতাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষকে পাবার জন্য মানুষ তার জন্মদাতা পিতা, জন্মদাত্রী মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করতে কষ্ট লাগে না। কারণ, সে বাবা-মায়ের চেয়েও কাউকে বেশি ভালোবাসে।
ভালোবাসাটা মানুষের জন্মজাত আবেগ। মানুষ জন্মের পর থেকেই মানুষকে ভালোবাসতে দেখে। সে কাউকে ভালোবাসার আগে আশেপাশের মানুষগুলো তাকে ভালোবাসতে দেখে। সে কিছু বলতে শেখার আগেই দেখে তাকে মানুষ খাইয়ে দিচ্ছে, তার দুর্গন্ধময় মল-মূত্র পরিস্কার করছেন। ভালোবাসা দেবার আগেই সে ভালোবাসা পেতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ভালোবাসা বিনিময় করে তার জীবনটা কেটে যায়।
মানুষের মনে যে ভালোবাসা আছে সেটা সহজাত। এটাকে টাকার সাথে তুলনা করা যায়। প্রত্যেকের হাতে এক লক্ষ টাকা আছে। সবাই এই টাকাগুলো কি একই ক্ষেত্রে ব্যবহার করবে?
না। কেউ এই টাকা বিনোদনের পেছনে ব্যয় করবে, কেউ এই টাকা বিনিয়োগ করবে, কেউ এই টাকার কিছু অংশ দান করবে। সবমিলিয়ে, কেউ টাকাগুলোর যথার্থ ব্যবহার করবে, কেউ অপব্যবহার করবে।
ঠিক তেমনি আমাদের সবার মধ্যে যে ভালোবাসা আছে সেই ভালোবাসাকে কেউ যথার্থ ব্যবহার করবে, কেউ করবে না।
আমাদের ভালোবাসাকে ‘পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট’ করতে হয়। বিজনেসে ‘পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট’ এর মূল কথা হলো- ‘তোমার ডিমগুলোকে একই বাস্কেটে রেখো না, আলাদা আলাদা বাস্কেটে রেখো’।
আমাদের ভালোবাসা অসীম না। আমাদের ভালোবাসা হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্মের মতো। নীলপদ্মগুলো কেবল একজনকে দিয়ে দিলে আরেকজনকে দেবার মতো কিছু থাকে না। আমরা যা করতে পারি সেটা হলো ভালোবাসার ‘পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট’। একেকটা বাস্কেটে আমাদের ভালোবাসাগুলো জমা রাখবো, সব ভালোবাসা একই বাস্কেটে রাখবো না। আবার যে বাস্কেটে যতটুকু ভালোবাসা জমা রাখার কথা, ততটুকু ভালোবাসা জমা না রাখলে পুরো ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের পতন ঘটবে।
একটা উদাহরণ দেই। গাড়িতে গ্যাস ঢুকানোর জন্য আপনি একটা গ্যাস পাম্পে গেলেন। গিয়ে দেখলেন গ্যাসের দাম গতদিনের চেয়ে দ্বিগুণ। গ্যাসের এতো দাম দেখে গাড়িতে গ্যাস না ভরে গ্যাসের ট্র্যাঙ্কে লেবুর জুশ ঢুকালেন। কারণ, লেবুর জুশের দাম কম। এখন বলুন, গাড়িটা চলবে?
গাড়ি তো চলবেই না, গ্যাসের ট্র্যাঙ্কে গ্যাস না ঢুকিয়ে লেবুর জুশ ঢুকানোর জন্য গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে। গাড়িটি রিপেয়ার করতে হবে।
ঠিক তেমনি, ভালোবাসা রাখার জন্য আমাদের হৃদয়ে যেসব বাস্কেট আছে সেসব বাস্কেটে কেবল ঐ ভালোবাসা রাখতে হয়, যে ভালোবাসা সেই বাস্কেট ধারণ করতে পারবে। এক ধরণের ভালোবাসার বাস্কেটে আরেক ধরণের ভালোবাসা, কিংবা যে বাস্কেটে যতটুকু ভালোবাসা ধারণ করতে পারবে তারচেয়ে বেশি ভালোবাসা রাখলে ঐ গ্যাসের গাড়ির মতো অবস্থা হবে। [১]
দুই.
প্রত্যেক মানুষের ভালোবাসার একটা কেন্দ্রবিন্দু আছে। যে কেন্দ্রকে ঘিরে ভালোবাসার সাইকেলটা ঘুরে। ভালোবাসার প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- ভালোবাসার নিউক্লিয়াসে কে অবস্থান করছেন? সেটা মানুষ হতে পারে, কোনো বস্তু হতে পারে। এই কেন্দ্রবিন্দুকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন চলে।
ভালোবাসার কেন্দ্রে যদি মা-বাবা থাকেন, তাহলে মা-বাবাকে খুশি করার জন্য সারাটা জীবন মানুষ কাটিয়ে দেয়। নিজের পড়ালেখা, চাকরি, বিয়ে সবকিছু ঠিক করে মা-বাবাকে কেন্দ্র করে।
ভালোবাসার কেন্দ্রে যদি গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড/স্বামী-স্ত্রী থাকে, তাহলে তাদেরকে ঘিরেই জীবনটা ঘুরে। তাদের খুশি রাখার জন্য যা যা করা লাগে মানুষ তা-ই করে।
ভালোবাসার কেন্দ্রে যদি অর্থসম্পদ থাকে, তাহলে অর্থসম্পদকে কেন্দ্র করেই জীবনটা ঘুরে। জীবনের একটাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়- কিভাবে অর্থোপার্জন করতে হবে? অর্থোপার্জনের জন্য প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলা, মানুষকে ঠকানো এমনকি কাউকে হত্যা করতেও কেউ পরোয়া করেনা।
ভালোবাসার কেন্দ্রে যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মানুষ যা ইচ্ছে তা-ই করে। প্রয়োজনে নিজের রক্তের সম্পর্কের কাউকে খুন করতে তার হাত কাপে না।
মানুষ যাকে তার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে সেটা তার ‘প্রভু’ বা মাস্টার হয়ে যায়। সে এই ভালোবাসার কারণে জীবন দিতে পারবে, জীবন ছিনিয়ে নিতে পারবে। এটা যদি অর্থ হয় তাহলে অর্থ হয়ে যায় তার প্রভু, এটা যদি ক্ষমতা হয় তাহলে ক্ষমতা হয়ে যায় তার প্রভু, এটা যদি তার প্রিয়জন হয় তাহলে তার প্রিয়জন হয়ে যায় তার প্রভু।
তাহলে মানুষের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে কী থাকবে?
তিন.
একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হাত ধরলেন। রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন ব্যবহার ছিলো খুবই রেয়ার। উমর (রাঃ) তৎক্ষণাৎ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার নিজের পরে আপনিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়?” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “না, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! তোমার কাছে আমি যেন তোমার চেয়েও প্রিয় হই।”
উমর (রা:) বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন,
“আল্লাহর কসম! এখন থেকে আপনি আমার কাছে আমার চেয়েও প্রিয়।”
উমরের (রাঃ) উত্তর শুনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে ঈমানের সার্টিফিকেট দিলেন-
“উমর! এখন তুমি সত্যিকারের ঈমানদার হলে।” [সহীহ বুখারী: ৬৬৩২]
আরেকটা হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
“তোমাদের কেউ প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার নিকট আমি তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হই।” [সহীহ বুখারী: ১৫]
তারমানে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভালোবাসা হলো- পার্ট অফ ফেইথ, ঈমানের অঙ্গ। একজন মানুষ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কাছে পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে প্রিয় না হন। ঈমানদার হতে হলে ভালোবাসার প্রায়োরিটি লিস্টে প্রথমেই রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাখতে হবে। অন্যথায় কেউ ঈমানদার হতে পারবে না।
ভালোবাসার প্রায়োরিটি লিস্টে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাখা মানে কী? রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুগত্য করা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বলেছেন তা করা, যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনুগত্য করা হলে সরাসরি আল্লাহর আনুগত্য করা হয়।
আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে বলেন:
“যে রাসূলের আনুগত্য করলো, সে আল্লাহর আনুগত্য করলো।” [সূরা আন-নিসা ৪:৮০]
যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই বলে দিচ্ছেন, আমাদের ভালোবাসার প্রায়োরিটি লিস্টে কী রাখতে হবে, কাকে রাখতে হবে। তিনি জানেন, এই লিস্টে কাকে রাখলে আমাদের ভালোবাসার যথার্থ ব্যবহার হয় আর কাকে রাখলে ভালোবাসার অপব্যবহার হয়। কার জন্য কতটুকু ভালোবাসা আমাদের হৃদয়ের ঝুড়ি ধারণ করতে পারবে সেই অনুযায়ী তিনি আমাদের হৃদয়ের ঝুড়িগুলো তৈরি করেছেন।
ঠিক এই জায়গায় যদি আমরা গ্যাস ভরার ট্র্যাঙ্কে লেবুর জুশ ভরার মতো ভালোবাসার ঝুড়িতে যাকে রাখা উচিত তাঁকে না রেখে অন্য কাউকে, অন্য কোনো বস্তুকে রাখি? তখন গাড়ির ট্যাঙ্কের মতো আমাদের হৃদয়ের ঝুড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
সেই জায়গা আরেকজন ‘প্রভু’ এসে দখল করে নেয়। হৃদয়ের যে জায়গা, যে কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহকে কেন্দ্র করে আবতর্ন করার কথা, তা যদি অন্য কাউকে কেন্দ্র করে ঘুরে তাহলে আমরা সেই বস্তু, সেই মানুষের উপাসক হয়ে যাই।
হৃদয়ের এই কেন্দ্রবিন্দুটা শুধুমাত্র আল্লাহকে কেন্দ্র করে ঘুরার কথা। আল্লাহর জায়গায় এই কেন্দ্রবিন্দু যদি অন্য কারো জন্য ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়। যা স্পষ্টত শিরক।
আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে বলেন:
“আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় দৃঢ়তর।” [সূরা আল-বাকারা ২:১৬৫]
মানুষ আল্লাহকে ভালোবাসবে কিভাবে? এই কথাটিও আল্লাহ কুর’আনে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাধ্যমে জানিয়ে দেন:
“বলো- যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার (রাসূলের) অনুসরণ করো, (এতে) আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আরে-ইমরান ৩:৩১]
আল্লাহকে ভালোবাসা মানে এই না যে মানুষ আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। মা-বাবার ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, সন্তানের জন্য ভালোবাসা, ভাই-বোন-বন্ধুর জন্য ভালোবাসা এরকম সহজাত ভালোবাসাকে আল্লাহ এপ্রুভ করেন, এমনকি আল্লাহ উৎসাহিত করেন। বাট, উইথ এ কন্ডিশন।
আল্লাহ এমন সহজাত ভালোবাসার একটা সীমারেখা টেনে দেন। সেই ভালোবাসা কখনো আল্লাহর চেয়ে বেশি হতে পারবে না।
আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে বলেন:
“বলো- তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছো, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হবার আশঙ্কা তোমরা করছো এবং সে বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করছো, তা যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে যুদ্ধ করার চেয়ে, তবে তোমরা আল্লাহর নির্দেশ না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।” [সূরা আত-তাওবা ৯:২৪]
চার.
ভালোবাসার নিউক্লিয়াসে আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে বসালে কী হয়?
এর উত্তর খুঁজেন জায়ান্ট স্কলার ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি বলেন:
“যে ভালোবাসা আল্লাহর জন্য হবে না তাতে তিনটি শাস্তি অবশ্যই থাকবে।
যতক্ষণ না সে তা না পাচ্ছে ততক্ষণ সে কষ্ট পাবে।
যখন পাবে তখন কষ্টে থাকবে কয়েক ধরনের, তা হারানোর, তা চলে যাবার, নষ্ট হওয়ার কিংবা তার বিরুদ্ধে যাওয়ার ইত্যাদি।
তারপর যখন তা হাতছাড়া হবে তার কষ্ট বহু গুণ বেড়ে যাবে।
এ হচ্ছে দুনিয়ার বুকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে ভালোবাসার তিন শাস্তি।”
উক্তিটা কতোটা সত্য সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো মানুষকে যদি ভালোবাসার নিউক্লিয়াসে বসানো হয় তাহলে তাকে না পাওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ কষ্ট পায়। পাবার পর হারানোর ভয় থাকে। তারপর যখন হারিয়ে ফেলে তখন তার কষ্ট বহুগুণ বেড়ে যায়। একই কথা অর্থ, ক্ষমতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
দিনশেষে প্রশ্ন হলো, আমাদের ভালোবাসার নিউক্লিয়াসে কে অবস্থান করছেন? কারণ, ভালোবাসার নিউক্লিয়াসে যার অবস্থান, তাঁর কথা মেনে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হবার কথা না।